রংপুরের ইউএনও’র নির্দেশ অমান্য : পকেট ভারী নেতাকর্মী-ব্যবসায়ীদের কৃষকরা হতাশ-বদরগঞ্জে গম ক্রয়ে অর্ধকোটি টাকার বাণিজ্য


হাজী মারুফ রংপুর বুরে‌্যা অফিস: দীর্ঘ আড়াই মাস পর রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার খাদ্যগুদামে গম ক্রয় শুরু করা হয় গত ১৬ জুন। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম ওই তারিখ থেকে ২০ জুন রাত পর্যন্ত ৪৯২ মে. টন গম ক্রয় শেষ করেছেন। তবে এই গম কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কৃষকদের নামে নেতাকর্মীরা গুদামে গম
দিয়েছেন। এতে অর্ধকোটি টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগ পেয়ে গত ১৮ জুন গম ক্রয় সংগ্রহ কমিটির সভাপতি ইউএনও খন্দকার ইশতিয়াক আহমেদ গম ক্রয় বন্ধের নির্দেশ দিয়ে ওইদিন তিনি অফিসিয়াল প্রশিক্ষণে চিন দেশে যান। কিন্তু তার নির্দেশ অমান্য করে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গুদাম কর্মকর্তা ২০ জুন পর্যন্ত গম ক্রয় অব্যাহত রেখে ক্রয় অভিযান করেন
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলার দুজন জনপ্রতিনিধি গম ক্রয়ের একদিন আগে ইউপি চেয়ারম্যানদের সাথে আলোচনা করে প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ২০জন করে ইউপি চেয়ারম্যানদের মনোনিত কৃষকদের নামের তালিকা জমা দেওয়া হয় খাদ্যগুদামে। ওই তালিকায় ইউপি চেয়ারম্যানদের স্বাক্ষরের পাশাপাশি উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরও রয়েছে। চেয়ারম্যানদের মনোনিত কৃষকদের নামে গুদামে গম দিয়েছেন ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মীসহ দুএকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এতে বাদ যায়নি ক্রয় কমিটির সদস্যরাও। ঝুটঝামেলা এড়াতে স্থানীয় কতিপয় সাংবাদিকদের নামেও ২০ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়
গত মে মাসে উপজেলা কৃষি বিভাগ দুই হাজার ২৮৩ গমচাষির নামের তালিকা খাদ্য বিভাগে জমা দেয়। ১১ মে ওই তালিকা অনুযায়ী গম ক্রয় অভিযান শুরু করা হয়। ১৪ মে সাবেক ছাত্রলীগের এক নেতা তালিকায় অনিয়মের অভিযোগ এনে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগ আলোকে খাদ্য নিয়ন্ত্রক ১৫ মে থেকে গম ক্রয় বন্ধ করে দেন। এর পর খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক কতিপয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগসাজস করে কৃষি বিভাগের তালিকা বাদ দিয়ে গত ১৬ জুন থেকে গম ক্রয় অভিযান শুরু করেন। তার আগে কোন জনপ্রতিনিধি এবং কোন নেতারা কতটন করে গম গুদামে দিবেন সেই তালিকা চলে যায় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে। ওই তালিকা অনুযায়ী গুদামে গম ক্রয় শুরু করা হয়। ফলে উপজেলার কোন কৃষক তাদের ৎপাদিত গম গুদামে দিতে পারেননি
সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে গম ক্রয় না করার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক প্রতিবেদককে বলেন, ভাইবাস্তবতা অনেক কঠিন। সঠিক ভাবে গম ক্রয় করতে গেলে আমাকে মাইর খেতে হবে। আমার মান সম্মান আছে, সামান্য গমের জন্য আমি মাইর খাবো কেন? তিনি নেতাকর্মীদের ভাগভাটোয়ারার তালিকা প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলেন, এই দেখেন তালিকা দিয়েছেন একজন জনপ্রতিনিধি। এর বাইরে আমার এক ছটাক গম কেনার ক্ষমতা নেই
জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিটন গমের বাজার মুল্য ১৮ হাজার টাকা। আর সেই গম গুদামে ২৮ হাজার টাকা। অর্থা বাজারের চেয়ে গুদামে প্রতিটনে ১০ হাজার টাকা বেশি। এতে ৪৯২ টনে বানিজ্যে হয়েছে প্রায় অর্ধকোটি টাকা
জানা গেছে, ওই নেতাদের কারও ঘরে গম ছিল না। তারা গমের বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে স্লীপ বিক্রি করেছেন। আর ব্যবসায়ীরা রাতের আধারে গুদামে গম ঢুকিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিবস্তা গমে ৫০ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে ৪৯২টনে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন ওই দুই কর্মকর্তা
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধিদের নিকট থেকে ওই  গমের বরাদ্দের স্লীপ ক্রয় করে খাদ্যগুদামে গম দিয়েছেন স্থানীয় গম ব্যবসায়ী গমভুট্টু, নিখিল চন্দ্র রায়, শাহ আলম, মোজাফ্ফর হোসেনসহ ১০-১২ জন ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে বেশির ভাগ স্লীপ কিনে গুদামে গম দিয়েছেন গমভুট্টু নিখিল। তারা দুজনে স্লাপ কিনে ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নিখিল চন্দ্র বলেন, ভাই আমি ১৫০টনের ব্যবসা করেছি। লাভ বেশি করতে পারিনি। শুধু লাভ করেছি দামোদরপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আজিজুল হকসহ একজন ভাইস চেয়ারম্যানের স্লীপ কিনে
জানা গেছে, উপজেলায় ৪৯২ মে.টন গম ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ওই গম ক্রয়ের কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই সময়মত গম ক্রয় শুরু করেনি গুদাম কর্মকর্তা। তবে অভিযোগ রয়েছে ওই সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি কতিপয় সাংবাদিকরা স্থানীয় গম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গুদামে ওই গম দিয়ে আর্থিক ফায়দা লুটালেও তারা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কারণ উপজেলা খাদ্যগুদামে গম গেছে ইউপি চেয়ারম্যানদের দেওয়া কৃষকের নামে। সকল কৃষক জানেই না তাদের নামে গুদামে গম দেওয়া হয়েছে
উপজেলার কাঁচাবাড়ি গ্রামের কৃষক আহকামুল হকের (৬০) নামে গুদামে তিন মে.টন গম দেওয়া হয়েছে। সোমবার তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, বাবামুইতো ইবার (এবার) গম আবাদ করো নাই। ফির গুদামোত মোর নাম গেইলো কিভাবে? কাঁচাবাড়ি বানিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক শাহ আলমের (৩৫) নামে গুদামে টন গম দেওয়া হয়েছে
গত সোমবার তার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী বিউটি বেগম বলেন, আমার স্বামী এবার গম আবাদ করিনি।  তিনি গুদামে গম দিলেন কিভাবে?
উপজেলার আমরুলবাড়ি গ্রামের কৃষক হাজ্জাজুল আলম বলেন, আমি এবার ৬০ শতক জমিতে গম চাষ করেছি। কৃষি অফিসের দেওয়া তালিকায় আমার নামও ছিল। কিন্তু খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে আমি গুদামে গম দিতে পারিনি। একই কথা বলেন লোহানীপাড়ার কৃষক দুলাল, কালপাড়ার জাহিদুল হক, আমরুলবাড়ির কাশেম
মধুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আয়নাল হক একজন জনপ্রতিনিধি নাম উল্লেখ করে বলেন, আমরা ওই জনপ্রতিনিধির নির্দেশে ইউনিয়ন প্রতি ২০ জন কৃষকের নামের তালিকা জমা দিয়েছি। ইউনিয়ন ভিত্তিক বরাদ্দ ছিল ২০ টন করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৃষকরা এবার গুদামে গম দেয়নি। কারা দিয়েছে তা সবাই জানে। কিন্তু কেউ বলবে না। শুধু এতোটুক্ ুবলবো গুদামে গম দেওয়া নিয়ে লুটতারাজ হয়েছে
সদ্য বদলি হওয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ মুঠোফোনে বলেন, আমি মে মাসে উপজেলার দুই হাজার ২৮৩জন কৃষকের নামের তালিকা খাদ্য অফিসে জমা দিয়েছি। কিন্তু খাদ্য নিয়ন্ত্রক অস উদ্দেশ্যে সেই তালিকায় কৃষকের গম ক্রয় করেননি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি থাকা অবস্থায় নতুন করে কোন কৃষকের নামের তালিকা সেখানে জমা দেওয়া হয়নি
বর্তমান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান বলেন, আমি খাদ্য গুদামে কোন কৃষকের নামের তালিকা দেইনি। যদি গুদামে নতুন তালিকা জমা হয়, তাহলে অবশ্যই উপসহকারি কৃষিকর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান বাজারে প্রতিকেজি গমের মূল্য হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। আর খাদ্যগুদামে তার দাম ২৮ টাকা। একটন গম গুদামে দিলে ১০ হাজার টাকা লাভ। কারণে সময়মত গম ক্রয় শুরু করা হয়নি। তিনি বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা গুদামে গম ধান দিতে পারেন না। কিন্তু এবারে ওপেন সিন্ডিকেট
ব্যাপারে গুদামের ভারপাপ্ত খাদ্য কর্তকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, গম ক্রয়ের কি হয়েছে, সে বিষয়ে আপনি (সাংবাদিক) খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সাথে কথা বলেন। প্রতি বস্তায় ৫০ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ঘুষ নিয়েছি, এর প্রমাণ কি আপনার কাছে আছে?
অনিয়ম করে গম ক্রয়ের কারণ জানতে চাইলে ক্রয়কমিটির সদস্য সচিব খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক বলেন, ভাইকেন আপনি বরাদ্দের ভাগ পাননি? আপনাদের (সাংবাদিকদের) নামে ২০ টন গম বরাদ্দ ছিল। কে সাংবাদিকদের নামে এই গম গুদামে দিয়েছেন-জানতে চাইলে তিনি একটু চুপ থেকে বলেন, আচ্ছা, আপনি কিছুই জানেন না, ঠিক আছে আপনি যান, আমি একজন প্রতিনিধির সাথে কথা বলে আপনাকে পরে জানাচ্ছি
বদরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পদক মাসুদ রানা বলেন, শুনেছি ওই তালিকায় সাংবাদিকদের নামে ২০টন গম বরাদ্দ ছিল। কিন্তু সেই গম গুদামে কে ঢুকিয়েছেন, আর কে টাকা নিয়েছেন, এর আজও হদিস পাইনি। তালিকায় সাংবাদিকদের নাম ছিল কি না তা নিশ্চিত হতে প্রতিবেদক কথা বলেন খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হকের সাথে
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের নামে ২০ টন বরাদ্দ গম ছিল। গমভুট্টু ওই গম গুদামে দিয়েছেন। গমভুট্টু বলেন, সাংবাদিকের ৮০ হাজার টাকা আমার কাছে রয়েছে
উপজেলা ভারপাপ্ত ইউএনও এসিল্যান্ড কমল কুমার ঘোষ বলেন, আমি ওই বিষয়ে কিছু জানি না। উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বি সুইট বলেন, আমি কোন তালিকা তৈরি করিনি। যদি আমার নাম কেউ বলে থাকেন তাহলে এটা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বলেছেন
গম ক্রয় কমিটির উপদেষ্টা স্থানীয় সাংসদ আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক বলেন, গম ক্রয়ের বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। যদি গম ক্রয়ে কোন অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে এর দায়ভার খাদ্য নিয়ন্ত্রক গুদাম কর্মকর্তাকে নিতে হবে





পুরোনো সংবাদ

রংপুর 6869465299623711504

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item