ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজ না করেই বিল উত্তোলন রংপুর মহানগরীতে ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কারের নামে ২৫ কোটি টাকা লুটপাট দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা মেয়রের

হাজী মারুফ রংপুর আফিস বুরে‌্যা অফিস : 

বিভাগীয় শহর রংপুর মহানগরীর অভ্যন্তরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল খনন ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় ২৫ কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। বেশিরভাগ কাজ না করেই ঠিকাদারদের বিল প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়নি। শুধু তাই নয়; স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানের ভাইকে কাজ না করেই আড়াই কোটি টাকা বিল প্রদান করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
এক্ষেত্রে ছোট ভাইকে বিল প্রদান করার জন্য সচিবের ক্ষমতার অপব্যবহার করে পৌরসভা কর্তৃক দরপত্র আহ্বান এবং কাজ চলাকালীন চিঠি দিয়ে কাজটি দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয় এলজিইডি রংপুরকে। রংপুর পৌরসভার কাছ থেকে তদারকির দায়িত্ব বাতিলও করা হয় শুধু ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রংপুর মহানগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সিও বাজার এলাকা থেকে নগরীর মাহিগঞ্জ পাটবাড়ি পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামা সুন্দরী খালটি সংস্কার, খালের উপর সেতু নির্মাণ, খালের দু’ধারে ৫ ফুট প্রশস্থ ফুটপাত নির্মাণ, খালের প্রতিরক্ষা বাঁধসহ বিভিন্ন কাজের জন্য সাবেক পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুর রউফ মানিক দরপত্র আহ্বান করেন। ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের কাজ ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়। এরা হলেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম শহীদ খানের ছোট ভাই শামীম খান, সার্দূল হোসেন, হাবিবর রহমান ও শফিকুল ইসলাম নামে ৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজটি চলাকালীন রংপুর পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন করা হয়। এ সময় খালের ৫ শতাংশ কাজ না হলেও তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুর রউফ মানিক ও নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন সচিবের প্রভাবে তার ছোট ভাইসহ ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম বিল প্রদান করেন বলে অভিযোগ করেন সিটি মেয়র সরফুদ্দিন আহাম্মেদ ঝন্টু। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান সিটি করপোরেশনের তত্ত্ব্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেনসহ প্রকৌশলীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সচিবকে খুশি করার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ কাজ না করেই অগ্রিম বিল প্রদান করেন। মেয়র ঝন্টু আরও অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র মানিক তার কাছে পরাজিত হওয়ার পর সচিব আবু আলম শহীদ খান তার কাছে সুবিধা করতে পারবে না মনে করে শ্যামা সুন্দরী প্রকল্পের কাজটি নিজের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এলজিইডি রংপুরকে দেখাশোনা থেকে শুরু করে সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করান। তিনি বলেন, পৌরসভা দরপত্র আহ্বান করল আর কাজটি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হলো এলজিইডিকে। এর মূল কারণ আমি অবৈধ সুবিধা দেব না। লুটপাট করতে দেব না বলেই সচিব এ কাজটি করেন বলে অভিযোগ করেন মেয়র ঝন্টু। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, দরপত্র অনুযায়ী শ্যামা সুন্দরী খালের দুই পার্শ্বের সিমেন্টের বোল্ডার বসানো, খালের দু'পাশে ৫ ফুট প্রস্থের ফুটপাত নির্মাণ এবং খাল খনন করে খালের উপর ৩টি সেতু নির্মাণ করার কথা। এজন্য খাল সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ২০ কোটি টাকা খাল খনন ও খালের উপর ৩টি সেতু ও একটি সংস্কার বাবদ ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খালের সদর হাসপাতালের পেছন থেকে গোমস্তপাড়া হয়ে নিউ সেনপাড়া রতন স্পোটিং কাব পর্যন্ত এ ৩ কিলোমিটারে কোন কাজই করা হয়নি। অথচ এ অংশটুকু খালের পাড় সংরক্ষণে ব্যয় ধরা ছিল ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সরজমিন ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে সিমেন্ট দিয়ে বোল্ডার দিয়ে খালের পাড় নির্মাণ ও দুই পার্শ্বের হাঁটার জন্য ৫ ফুট প্রশস্থ ফুটপাত নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পুরো ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা কিভাবে ব্যয় হলো তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি এলজিইডি রংপুরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। সূত্র আরও জানায়, ওই অংশের ঠিকাদার সচিবের ছোট ভাই শামীম খানকে কোন কাজ না করেই ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা প্রদান করেছে এলজিইডি রংপুর। তবে এ ব্যাপারে সাবেক সচিবের ভাই শামীম খান বলেছেন, তিনি এলজিইডির প্রকৌশলীদের নির্দেশনা মতো কাজ করেছেন। কাজ করেই তিনি তার পাওনা বিল পেয়েছেন, কাজ না করে তাকে কোন বিল দেয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। 
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডির একজন প্রকৌশলী জানান, ওই অংশে ওইসব কাজ করা হয়নি সত্যি, কিন্তু সচিবের ভাইকে খালের পাড়ে মাটি কাটার কাজ করা দেখিয়ে ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। কেন দরপত্রে উল্লেখ করা কাজ না করে শুধু মাটি কাটার কাজ করানো হলো এর কোন ব্যাখ্যা কোন প্রকৌশলী দিতে পারেনি। অন্যদিকে নগরীর নুরপুর হয়ে পাটবাড়ি পর্যন্ত এলাকা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার এলাকায় খালের দু'পাশে ফুটপাত নির্মাণ ও খালের পাড় নির্মাণে ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা প্রাক্কলন ধরা ছিল দরপত্রে । কিন্তু ওইসব কাজের কিছুই না করে অল্পসংখ্যক সিমেন্টের তৈরি বোল্ডার বসিয়ে ঠিকাদারকে ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বিল প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে নগরীর সিও বাজার থেকে শুরু করে নিউ ইঞ্জিনিয়ারপাড়া সেতু পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকায় খালের পাড় সংরক্ষণের নামে পুকুর চুরি করার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে ৩ বছর আগের করা খালের পাড় সংরক্ষণ করা কাজকে পুনর্বার করা দেখানো হয়েছে। ওই এলাকার দু'পাশে ফুটপাত নির্মাণ করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। অন্যদিকে ফুটপাত নির্মাণের ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকৌশলীরা জানান, ফুটপাতের নীচে ২ ফুট বালু ও মাটি ভরাট করে গাথুনী করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। কিছু কিছু এলাকায় বোল্ডার নির্মাণ করা হলেও তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এ ছাড়াও জিও মাটি দিয়ে টেঙ্টাইল কমপেক্ট করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ ছাড়াও ওই এলাকায় খোয়া দিয়ে স্লাব তৈরি করে জিও টেঙ্টাইল করার পর তার ওপর বক্স রাখার কথা থাকলেও তার কোনটাই করা হয়নি। মোট কথা ফুটপাত নির্মাণের আগে ও পরে এবং সিমেন্টের তৈরি বোল্ডার লাগানোর পরে যেসব কাজ করার দরপত্রে উল্লেখ আছে তার কোনটাই করা হয়নি যা উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে বলে খোদ এলজিইডির প্রকৌশলীরা জানান। এ ভাবেই কাজের নামে প্রহসন করে এবং কাজ না করেই কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। 
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, এসব ঘটনার নায়ক হচ্ছেন তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ। তিনি সচিবের ভাইসহ অন্যান্যদের কাজ সম্পন্ন করার আগেই বিল প্রদান করার জন্য একটি সাজানো নাটক করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায় স্মারক নম্বর ১১৫৯/২তারিখ ২৪.০৩.১৩ইং তারিখে নির্বাহি প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ রংপুর শ্যামাসুন্দরী খাল উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের পরিমান, পরিমাপ ও মান রক্ষা করার জন্য সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী শাহারুল আলম মন্ডলকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দেন। পত্র দেয়ার আগে সদস্যদের কাজের গুনগত মান ভালো কাজ হয়েছে বলে একটি প্রত্যয়ন পত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন। কিন্তু কমিটির দুই সদস্য সহকারী প্রকৌশলী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দফতর রংপুরের আবুল কালাম আজাদসহ দু'জন প্রকৌশলী স্বাক্ষর করতে অস্বিকার করায় পরের দিনই তাদের রংপুর থেকে দিনাজপুরে স্টান্ড রিলিজ করে দেয়া হয়। এরপর নির্মাণের স্থল পরিদর্শন না করেই একটি সাজানো মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করানো হয়। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান শাহারুল ইসলামকে একাধিকবার দেখা করে কি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলছি বলবো বলে এড়িয়ে যান। আর এভাবেই শ্যামাসুন্দরী খাল খননসহ বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন না করেই প্রকল্পটি গত ডিসেম্বর মাসে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর সত্যতা স্বীকার করে সহকারী প্রকৌশলী শাহারুল আলম জানানÑ কিছু অংশের কাজ শেষ না হবার আগেই শেষ দেখাতে হয়েছে। কারন প্রকল্পটি ৩ বছর ধরে চলছিল। তিনি আরও জানান, প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার মধ্যে ২১ কোটি ৭৯ হাজার টাকা খরচ করে বাকি ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। কাজ না করে বিল প্রদান করার ব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করতেই রাজি হননি। অন্যদিকে নির্বাহি প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ অনত্র বদলী হয়ে যাওয়ায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র সরফুদ্দিন আহাম্মেদ ঝন্টু অভিযোগ করেন, শ্যামাসুন্দরী খাল খননসহ এর উন্নয়ন কাজের নামে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান সে সময় সচিব থাকায় যে দাপট দেখিয়ে চরম ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম করেছেন, ভাইকে অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন, আর কাজ না করেই বিল দেয়ার যে অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে তা উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত করে দায়িদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।

অনুসরণ করুন

সর্বশেষ সংবাদ

Logo

ফেকবুক পেজ

কৃষিকথা

আপনি যা খুঁজছেন

গুগলে খুঁজুন

আর্কাইভ থেকে খুঁজুন

ক্যাটাগরি অনুযায়ী খুঁজুন

অবলোকন চ্যানেল

item